দোল উৎসব ও শ্রী শ্রী ঁ নারায়ণের অনন্তশয্যা পূজা

Social

অভিজিৎ হাজরা, আমতা, হাওড়া :-সৃষ্টির আদিকাল থেকে সৃষ্টিকর্তা চতুরানন ব্রহ্মার জম্মবৃতান্ত সম্বন্ধে যেটুকু আমরা মর্ত্যবাসী জনেছি তা হল চক্রধারি নারায়ণের নাভি থেকে পদ্মযোনি ব্রহ্মার আর্বিভাব এবং পদ্মের উপর উপবিষ্ট হয়ে তপস্যায় নিমগ্ন।আর ও কথিত আছে যে, বিষ্ণুর কর্ণমূল থেকে উদ্ভুত দৈত্য ব্রহ্মাকে বধ করতে উদ্যত হলে বিষ্ণু – মধু ও তার ভ্রাতা কেটভকে বিনাশ করেন। সেই জন্যই বিষ্ণুর নাম হয় মধুসূদন ও মধুকৈটভারি।এই কথাগুলি আদি পুরাণে বর্ণিত আছে।পুরাণে আরও বর্ণিত আছে যে ক্ষীরোদ সাগরে অনন্ত নাগ কুন্ডলীকৃত অবস্থায় ভাসমান পদ্মের মধ্যে সপ্তমুখমন্ডল ধারণপূর্বক লক্ষী- নারায়ণের মস্তক ছত্রবৎ আচ্ছাদিত করে আছে।আর সেই সময় দেখা যায় লক্ষী নারায়ণের পদসেবায় রত। এটাই হল নারায়ণের চিরকালীন অনন্তশয্যা।

দোল উৎসব কে কেন্দ্র করে গ্ৰামীণ হাওড়া জেলার আমতা থানার সোমেশ্বর গ্ৰামের মানুষ মেতে উঠেছেন সর্বজনীন শ্রী শ্রী ঁ নারায়ণের অনন্তশয্যা – আরাধনায়।
এই পূজার ইতিহাস প্রসঙ্গে গ্ৰামের প্রবীণ বিদগ্ধ মানুষজনদের কাছ থেকে জানা যায়,১৩৩৯ বঙ্গাব্দে এলাকার যুবক – যুবতীদের নিয়ে সোমেশ্বর গ্ৰামের বাসিন্দা স্বাধীনতা সংগ্ৰামী ভোলানাথ মাল শিক্ষার উন্নতি ও বিপ্লবী মনোভাব গড়ে তোলার জন্য বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলির অনুপ্রেরণায় ” সোমেশ্বর সাধারণ
পাঠাগার ” গঠন করেন। সোমেশ্বর,সন্তোষনগর,কুমারিয়া সহ অন্যান্য গ্ৰামের কিশোর – কিশোরী,যুবক- যুবতী রাত এই পাঠাগারের সঙ্গে যুক্ত হন।অপর দিকে বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলির নির্দেশে সোমেশ্বর প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ে চলত শরীর শিক্ষা,ব্যায়াম ও বিপ্লবী চেতনার শিক্ষা ও মন্ত্র। সেই সঙ্গে সোমেশ্বর ব্রহ্মাতলায় ছয় থেকে সাতটি গ্ৰামের যুবকরা আসত যাত্রা শিক্ষার জন্য।
২৯ শে শ্রাবণ ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের শুক্রবার ভারতবর্ষ স্বাধীনতা লাভ করে। সেই আনন্দে সোমেশ্বর গ্ৰাম নিবাসী ভ্রমণপিপাসু প্রয়াত হরিশচন্দ্র বর ১৩৫৪ বঙ্গাব্দের দোল পূর্ণিমার কয়েক দিন আগে পুরী ধামে বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি জগন্নাথ ঘাটে শ্রী শ্রী ঁ নারায়ণের অনন্তশয্যা -র মূর্তি দেখে মোহীত হন । তৎক্ষণাৎ তিনি মনে মনে সংকল্প করেন এই ধরণের মূর্তি তিনি নিজ গ্ৰাম সোমেশ্বরে তৈরি করে পূজা করবেন। তিনি ঐ মূর্তির ছবি সংগ্ৰহ করে আনেন।
পুরী ধাম থেকে ফিরে এসে তাঁর সংকল্পের কথা গ্ৰামের ব্রহ্মাতলায় এক সভা ডেকে তৎকালীন সময়ে গোবিন্দ্র পাত্র,মণিন্দ্র পাত্র,পতাই কোলে,বৈদ্যনাথ কোলে,রতীকান্ত পন্ডীত,পানু মাজী,অষ্টম মাজী,যতন কোলে,পরেশ মাজী, সুধাসিন্ধু কোলে,নিরাপদ কোলে,গৌরমোহন ময়রা,মুরারী দে,স্বাধীনতা সংগ্ৰামী ভোলানাথ মাল, স্বাধীনতা সংগ্ৰামী ভবতারণ হাজরা,তারাপদ মন্ডল,নারায়ণ পারাল, বাসুদেব পাত্র,যুগল মাজী, মদনমোহন বর,দুলাল পল্যে,শীতল পাছাল,আনন্দ পাত্র,তারাপদ পাত্র, রতনচন্দ্র হাজরা ,মণিমোহন হাজরা,শংকর হাজরা,ও অন্যান্য দের উপস্থিতে পুরী ধামের জগন্নাথ ঘাটে দেখে আসা শ্রী শ্রী ঁ নারায়ণের অনন্তশয্যা মূর্তির পূজা গ্ৰামে করতে চান বলে জানান।সকলে চিন্তা – ভাবনা করে শ্রী শ্রী ঁ নারায়ণের অনন্তশয্যা -র সেই মূর্তির ছবি দেখতে চাইলে তিনি সেই ছবি দেখান।সেই ছবি দেখে তার সংকল্পের কথা মেনে নিয়ে সকলেই গ্ৰামে ঐ পূজা করার মনস্থির করেন।
১৩৫৫ বঙ্গাব্দে দোল পূর্ণিমার দিন সোমেশ্বর গ্ৰাম নিবাসী নিরাপদ কোলে – র বাগানে এই পূজা শুরু হয়। মূর্তি তৈরি করেছিলেন থলিয়া গ্ৰামের মৃৎশিল্পী জয়ন্ত দাস। তৎকালীন সময়ে এই পূজার পৌরহিত্য করেছিলেন সোমেশ্বর গ্ৰাম নিবাসী মণিমোহন চক্রবর্তী। পূজা সভাপতি হন পুজার প্রতিষ্ঠাতা হরিশচন্দ্র বর এবং সম্পাদক হন নিরাপদ কোলে।
তখন সপ্তাহ ব্যাপী এই পূজা খরচ হয়েছিল ৪,০০০(চার হাজার) টাকা ।ডে -লাইট ,মাইক,প্যান্ডেল ,পূজার আনুষ্ণাঙ্গিক খরচ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সহ।
দ্বিতীয় বৎসর ১৩৫৬ বঙ্গাব্দে সোমেশ্বর বাঁধ সংলগ্ন উত্তর দিকে অর্থাৎ বর্তমানে যেখানে গোপাল কোলে (বাপন ডেকরেটার্স) -র বাড়ি ঐ স্থানে পূজা হয়।১৩৬২ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত ৭ বছর এই পূজা একটানা হয়।
১৩৬৩ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩৮০ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত আর্থিক অবস্থা ও অন্যান্য সহযোগিতার অভাবের কারণে এই পূজা করা সম্ভবপর হয় নি।
ইতিমধ্যে দামোদর নদ দিয়ে বয়ে গেছে অনেক জল, কালের চাকা গতি পরিবর্তন করেছে। স্বাধীনতা সংগ্ৰামী ভোলানাথ মাল প্রতিষ্ঠিত ‘সোমেশ্বর সাধারণ পাঠাগার’ নাম পরিবর্তন করে হয়
‘ পাগলা ফৌজ ‘।তারপর নাম পরিবর্তন করে হয় ‘সোমেশ্বর আধুনিক সংঘ ‘।
১৩৮১ বঙ্গাব্দে ‘ আধুনিক সংঘ ‘ – র সভ্য – সভ্যাবৃন্দ পুনরায় শ্রী শ্রী ঁ নারায়ণের অনন্তশয্যা পূজা চালু করার মনস্থির করেন গোবিন্দ্র পাত্র,নিরাপদ কোলে, বাসুদেব পল্যে,শীতল পাছাল, আনন্দ পাত্র, তারাপদ পাত্র,আনন্দ পাত্র,সন্যাসী পাত্র,বরিষণ দাস ও অন্যান্য মানুষজনদের সহযোগিতায় ।১৩৫৫ বঙ্গাব্দের দোল পূর্ণিমার দিন যারা এই পূজা শুরু করেছিলেন তাদের অনেকেই বর্তমানে প্রয়াত হয়েছেন।
তাঁদেরই সন্তান – সন্ততিরা যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে পূজা অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এখনো মহাসমারোহে চালিয়ে যাচ্ছেন।
শ্রী শ্রী ঁ নারায়ণের অনন্তশয্যা -র মূল মন্ডপে দেখা যায়,৭ টি শেষনাগের ফণার নীচে জগৎপতি নারায়ণ পা মিলে বসে আছেন যার এক হাতে সুদর্শন চক্র,এক হাতেপদ্ম ফুল,এক হাতে শঙ্খ,অন্য হাতে গদা। ঁনারায়ণের নাভি কুন্ডল থেকে ঁ ব্রহ্মার সৃষ্টি। ঁনারায়ণের পদতলে ঁ লক্ষী ঁনারায়ণের পদ সেবায় রত এক হাতে ।ঁ লক্ষীর অন্য হাতে পদ্ম ফুল। ঁ লক্ষীর মাথায় ছায়া দিয়ে আছেন একটি শেষনাগের ফণা।মূল মন্ডপে ঁনারায়ণ ও ঁ লক্ষী কে ঘিরে রেখেছে নারায়ণের দশাবতার। যথাক্রমে
১/ মৎস – মাছরূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ, উল্লেখযোগ্য চরিত্র – বৈবস্বত মনু।
২/ কুর্ম – কচ্ছপের রূপে সত্যযুগে অবতীর্ণ, উল্লেখযোগ্য চরিত্র – মোহিনী।
৩/ বরাহ – বন্য শূকরের রূপে অবতীর্ণ, উল্লেখযোগ্য চরিত্র – জয় ও বিজয়,চতুষ্কুমার,হিরণ্যাক্ষ।
৪/ নৃসিংহ – অর্ধনরসিংহ রূপে অবতীর্ণ,উল্লেখযোগ্য চরিত্র প্রহ্লাদ,হিরণ্যকশিপু, নৃসিংহ ‌।
৫/ বামন – খর্বকায় বামনের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ, উল্লেখযোগ্য চরিত্র মহাবলী( দৈত্যরাজা)।
৬) পরশুরাম – পরশু অর্থাৎ কুঠারধারী রামের রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ, উল্লেখযোগ্য চরিত্র পরশুরাম,কার্তবীর্যার্জুন,জমদগ্নি।
৭/ রাম – অযোধ্যার যুবরাজ ও রাজা রূপে ত্রেতাযুগে অবতীর্ণ।
৮/ কৃষ্ণ – দ্বাপরযুগে জ্যেষ্ঠভ্রাতা বলরাম সাথে অবতীর্ণ।ভাগবত পুরাণ অনুসারে দ্বাপরযুগে অনন্তনাগের অবতার বলরাম রূপে কৃষ্ণের সঙ্গে অবতীর্ণ হন। অধিকাংশ বৈষ্ণব শাখা সম্প্রদায় বলরামকে বিষ্ণুর অবতার বলে মনে করেন।যে সকল সূত্রে বুদ্ধের কোনো উল্লেখ নেই সেখানে বলরামকেই বিষ্ণুর নবম অবতার রূপে দশাবতারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
৯/ বুদ্ধ – কলিযুগে বিষ্ণুর নবম অবতার হিসাবে অবতীর্ণ।
১০/ কল্কি – এই ভবিষ্যৎ অবতার কলিযুগের শেষ পর্বে অবতীর্ণ হবেন বলে হিন্দুরা মনে করেন।
এছাড়াও রয়েছেন প্যাঁচা,গড়ুর। মূল মন্ডপের সামনে একদিকে জয়া ,অন্য দিকে বিজয়া।সমস্ত মূর্তি গুলি মাটি দিয়ে নির্মিত করা প্রতি বৎসর।
এই দোল উৎসব ও পূজা উপলক্ষে ৭ থেকে ১০ দিন ব্যাপী হত নাটক,যাত্রা,যোগব্যায়াম প্রর্দশনী,তরজা,ম্যাজিক, কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠান সহ সুস্থ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
এই অনুষ্ঠান গুলিতে গ্ৰামের যুবক – যুবতীরা অংশগ্রহণ করেন।আস্তে আস্তে সুস্থ সংস্কৃতির অবলুপ্তি ঘটেছে।এখন গ্ৰামের যুবকরা নাটক – যাত্রা- র প্রতি আগ্ৰহ দেখাচ্ছেন না।তারা নাটক – যাত্রা – য় অভিনয় করতে এগিয়ে আসছেন না।তারা এখন বোকাবাক্স আর মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত।এখন যুবসমাজ বিচিত্রানুষ্ঠান এর প্রতি আসক্ত। বাইরে থেকে শিল্পী এনে নাতো ,গান ইত্যাদি ইত্যাদিতে অপসংস্কৃতিতে মেতে উঠছে সারারাত্রি ব্যাপী।গ্ৰামের মানুষের মনোরঞ্জনের জন্য সংঘ বাইরের গ্ৰাম থেকে নাটক – যাত্রার দল নিয়ে এসে অনুষ্ঠান করে থাকে।
এই পুজার বৈশিষ্ট্য হলো জাতি – ধর্ম – বর্ণ নির্বিশেষে হোলির রঙে সাথে মনের রঙ মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে যায়। এই পূজা অত্যন্ত শুদ্ধাচারে ও নিষ্ঠা সহকারে মহাসমারোহে পালিত হয় তিথি অনুযায়ী পুজো বসন্তের ফাল্গুনী পূর্ণিমার দোল উৎসবের দিন অনুষ্ঠিত হয়।পুজা এক সপ্তাহ কাল ব্যাপী বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চলতে থাকে। বিশেষ করে পুজার দিন সকাল থেকে আবাল বৃদ্ধ বণিতা সকলে মহানন্দে হোলি খেলায় মত্ত হয়ে উঠেন। এবং সেই সঙ্গে থাকে নগর পরিক্রমা। সন্ধ্যারতির পর ভোগ বিতরণের পর মানসিক রক্ষাপ্রাপ্ত পরিবারের সদস্য – সদস্যা বাতাসা ছড়ায়।যেটা হরির লুঠ নামের পরিচিত।
তারপর থাকে আতসবাজির বাহার।
দোল পূর্ণিমার দিন শ্রী শ্রী ঁ নারায়ণের অনন্তশয্যা পূজা পশ্চিমবঙ্গ তথা হাওড়া জেলার অন্য কোনো জেলায় হয় না।
এই পুজা উপলক্ষে বিভিন্ন দিনে আছে, আতসবাজির বাহার,ক্রীড়ানুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রক্তদান শিবির, নরনারায়ণ সেবা। নরনারায়ণ সেবায় সোমেশ্বর, সন্তোষনগর, কুমারিয়া, রসপুর, কলিকাতা,তালসহরা,ভোজান,বাগুয়া,বাজেপ্রতাপ,বালিচক,মান্দারিয়া,মিল্কিচক,আমতা,দঁকি, পুটখালী,চাকপোতা,খড়িয়প, অংশগ্রহণ করেন।
মৈনান,ধাঁইপুর সহ অন্যান্য গ্ৰামের মানুষ এমনকি সুদূর কলকাতা থেকে প্রায় বারো থেকে পনেরো হাজার মানুষ ।
শেষ দিন বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা সহকারে প্রতিমা বিভিন্ন গ্ৰাম প্রদক্ষিণ করে ‘ আধুনিক সংঘ ‘ -র পাশে দামোদর নদে বিসর্জিত হয়।

Leave a Reply