মলয় দে নদীয়া:-আরব্য রজনী নয়! মুসলমান সমাজকেন্দ্রিক হলেও গাজী মিঞার বিবাহকে কেন্দ্র করে নদীয়ার শান্তিপুর মালঞ্চের মাঠ সর্ব ধর্ম সমন্বয়ের মিলন স্থল। যা এখন উৎসবে পরিণত হয়েছে ।
শান্তিপুরের উল্লেখযোগ্য উৎসবের এক অনুষ্ঠান হলো গাজী মিঞার বিয়ে। বৈশাখ মাসের শেষ রবিবার অনুষ্ঠিত এই উৎসবে ঘুচে যায় ধর্মের ভেদাভেদ। বৈশাখ মাসের শেষ রবিবার শান্তিপুরের মালঞ্চে বিরাট এক মাঠে শুরু হয় উৎসব। গাজী মিঞার বিয়ে কথাটা এখন এসে দাঁড়িয়েছে গাজীমের বিয়েতে। গাজী মিঞা ছিলেন উত্তর প্রদেশের এক ধর্মপ্রাণ মুসলমান। জনশ্রূতি অনুযায়ী তিনি ছিলেন পারস্য সম্রাটের সেনাপ্রধান, তার সাথে জহুরা বলে একজনের বিয়ে ঠিক হয়। বিয়ে করতে যাবার পূর্ব মুহূর্তে যুদ্ধের ডাক আসে। তাদের বিয়ে আর হয় না। তবে গাজী মিঞা ওই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে বন্দী হোন নাকি তার মৃত্যু সে খোঁজ পাওয়া যায়নি, অন্যদিকে জহুরা প্রতীক্ষায় থেকে বহু বছর বাদে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু হয়।
অতৃপ্ত ভালোবাসার এই কাহিনীকে স্মরণীয় করে রাখতে, নদীয়ার শান্তিপুরে বসবাসকারী তৎকালীন সময়ের দু চার ঘর মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষজন এই মেলার সূচনা করেন। তবে সে সময় খৌনিশ চন্দ্র রাজা অনেক ফুলের বাগান সমৃদ্ধ এই অঞ্চলের নাম দেন মালঞ্চ, এবং তিনিই পরধর্ম সহিষ্ণু হয়ে এই ধর্মীয় ভাবাবেগ কে উৎসবে রূপ দেন। তারও পরবর্তী সময়ে মুসলমান সম্প্রদায়ের খন্দকারেরা এই মেলা প্রচার এবং প্রসার ঘটান। পূর্ব পাকিস্তান ভাগ হয়ে যাওয়ার সময়, তারা সেখানে চলেই গেলে স্থানীয়দের ওপর দায়িত্ব দিয়ে যান এই ঐতিহ্য বজায় রাখার।সেই থেকে আজ পর্যন্ত, ক্রমশ উত্তরোত্তর শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে এই মেলার।
শান্তিপুর সহ জেলা এবং রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষজন এসে গাজিম মিঞার কাছে মানত করে থাকেন সন্তান লাভ সহ শারীরিক বিভিন্ন রোগ মুক্তির। এবং তা কার্যকারী হলে পরের বছর, সাধ্য এবং মানত অনুযায়ী, মিষ্টি, মুরগি খাসির মাংস, সহযোগে দুপুরের মধ্যাহ্নভোজ করান এলাকার প্রান্তিক মানুষজনদের।
মূলত প্রতিবেশী দুটি পাড়া দুটি বাঁশে সিল্কের রঙিন কাপড় জড়িয়ে বাঁশের মাথায় কালো চামড় লাগিয়ে, প্রতীক্ষায় থাকেন বিবাহের। ঘটক ভাগ্নে অর্থাৎ এক কঞ্চি আমন্ত্রণ জানান মামা গাজী, মামি জহুরার কাল্পনিক বিবাহের। দুই পক্ষের দুই বাঁশ পাশাপাশি পোতা হয় গাজিমের মাঠে। বৈশাখের হাওয়ায় বাঁশের ডগায় লাগানো চামোরে বেঁধে দুই বাঁশে ঠোকাঠুকি লেগে যায়, ভেস্তে যায় বিয়ে, ঘোষণা হয় আসছে বছর আবারো হবে । সকলেই প্রতীক্ষায় থাকে এক বছর। আবারো এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, এভাবেই লোকসংস্কৃতি এখন উৎসবের চেহারা নিয়েছে।
এই উপলক্ষে মেলা চলে সাত দিন যাবত লক্ষাধিক দর্শনার্থীদের সমাগম ঘটে। তবে প্রথম তিনদিন, মেলার প্রধান আকর্ষণ কাঁচা মিঠা আম তাল শাঁস এবং লিচু বিক্রি হয় সারারাত ধরে। নাগরদোলা বাদাম জিলাপি সহ মেলা উঠে ভরে ওঠে নানান রকম মেলা উপকরণে।
স্থানীয় এবং পার্শ্ববর্তী ওয়ার্ডের কাউন্সিলরগন, এবং পুলিশ প্রশাসন থেকে সহযোগিতা পেয়েছেন বলেই জানিয়েছেন বর্তমান মেলার কর্মকর্তাগণ। তারা বলেন, অতীতে এই মেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়েছিলো, প্রয়াত জননেতা অজয়দের প্রচেষ্টায়। তবে বর্তমানে মেলা, বন্ধ করে সেই জায়গা প্রোমোটারির করার অপচেষ্টা চালায় কিছু অশুভ শক্তি। তাদের প্ররোচনায় প্রশাসনের একটা অংশ এই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে উৎসাহী হয় না। তবে তারা আশাবাদী আগামী দিনে ভুল ভেঙে মেলা হয়ে উঠবে সকলের।