গৌতম অধিকারী,
শিক্ষক, হিন্দু স্কুল, কলকাতা।
তরঙ্গিত বিদ্রোহে জাগে নদীময় আমার স্বদেশ । শীতসন্ধের মালদা শহরটা ঠিক কেমন, আজ আর মনে করতে পারি না। হিম পড়ত কেমন অনুভূতির আজকের প্রদেশ অবস্থান তার অনেক দূরে। কিন্তু এটুকু মনে আছে মালসায় টুকরো কাঠে আগুন জ্বালিয়ে আগুন পোহাতেন মেজো জ্যাঠামশাই গোপীনাথ অধিকারী। চাকরি করতেন পুলিশে, সাব ইন্সপেক্টর। কিন্তু স্বভাবে-বিভাবে একদম বিপরীত জগতের মানুষ। বড্ডো আয়েশি। সাহিত্যের অনুরাগী পাঠক। আগুন পোহাতে পোহাতে গল্প করতেন। মাঝে মাঝেই তাঁর মুখে শুনতে পেতাম পুরনো কাব্য-সাহিত্যের অদ্ভুত সব পঙ্ক্তিমালা। যেমন মনে আছে আগুনের মালসার পাশে বসে একদিন বলে উঠলেন, “বাঘের বিক্রম সম মাঘের হিমানী।’ বলতেন, বড়ো হলি পড়বা। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল কাব্য’। বাঁচা গেল। বড়ো তো হই আগে।
অতএব ভাবনা কী ? আমি না ভাবলে কী হবে ? জ্যাঠামশাই তো ছাড়েন না। মাঝে মাঝেই এসব সাহিত্যীয় অত্যাচার চেপে বসে মালদা রথবাড়ি এলকায় আমাদের শীতসন্ধে-যাপনটা একটু ভারী হয়ে যেত। একদিন তো ধেয়ে এল ভয়ঙ্কর ভাষামেঘ, ” সদ্যজাত শশারু কিরাতের করতলগত হইলে তাহার শাবকগণ যেমন অনাহারে শুকাইয়া মরে, তেমনি মরিবে এই প্রজাবৃন্দের সন্তানেরা।”
কিন্তু নিছক ভাষা যদি মেঘভাসা হতো ক্ষতি ছিল না কোনো। ভাষা এবার সদর্থক হতে চাইল, বলো তো দেখি ‘কিরাত’ মানে কী?
খুব স্বাভাবিক ব্যাপার যে আমাদের পক্ষে এই সব কঠিন কঠিন শব্দের অর্থ সেই বয়সে বলা সম্ভব ছিল না। কিন্তু নিশ্চিন্ত থাকতাম এই ভেবে যে এবার কোনো গল্পের অজানা জগতে আমাদের নিয়ে যাবেন জ্যাঠামশাই। হতোও সেটাই। বই না পড়েও ‘নীলদর্পণ’ নাটকের সব ঘটনা জেনে গিয়েছিলাম, চিনে নিয়েছিলাম সব চরিত্রকে। কথাটা ছিল প্রজাদরদী জমিদার-তনয় নবীনমাধবের।। শীতসন্ধেয় আমাদের সব শীতকারতা ভেঙে দিতেই তিনি শোনাতেন দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকের কথা। নীলকুঠির সাহেবদের অত্যাচারের গল্প। বারান্দায় বসে ঠাকুরমা সুভাষিণী দেবী খেই ধরতেন সেই গল্পের। রূপকথার মতোই ডানা মেলে সীমান্তপ্রহরা ভেঙে সেই রূপকথা ছুটে চলে যেত অন্য এক ভূগোলে, যে ভূগোলের এখনকার নাম বাংলাদেশ।
এই বাংলাদেশের একটা ছোট্ট ভূগোল, যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া আর আজকের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, উত্তর চব্বিশ পরগনা জুড়ে যে মধ্যবঙ্গ, সেই বঙ্গ জুড়ে ছিল একসময় নীল বাঁদরের থাবা। ঠাকুরমার গল্পগাঁথার সূত্র ধরে আমি পৌঁছে যাই আমার ‘এক যে ছিল দেশ’ অতিক্ষুদ্র একটা সীমানায়। যেখানে নদীর নাম কঙ্কণা, মাথাভাঙা, ইছামতী, চূর্ণী, অঞ্জনা, যমুনা, পলদা, খোড়ে, জলঙ্গি কিংবা গোরাগাঙনি। অতি শান্ত কন্যেটির মতো লাস্যময় তরঙ্গভঙ্গে খলবল করে ওঠে তাদের শরীর। কিন্তু বিদ্রোহের সঙ্গীতে যখন মুখর তখন বিদ্রোহের তরঙ্গভঙ্গে উথালপাথাল করে সমস্ত জলজগত। কুমুদরঞ্জন মল্লিক লিখেছিলেন,
কুলে কুলে তব দস্যুর থানা, আনন্দ ছিল মন্দ না,
করি আমি দেবীচৌধুরানীর এ জলমূর্তি বন্দনা।
আবার তোমার ঘাটে ঘাটে পাট, বাজে মৃদঙ্গ নিত্য যে,
রচিয়াছ বটে কতই নগরী, রচেছ কতই তীর্থ যে।
বিশে বোদে রানা প্রবল বিক্রমে করিল ও নীর কম্পিত,
দেবতা মানুষে বিবাদ দেখেছ, মানুষে মানুষে সম্প্রীত।
মূলত চূর্ণী নদীকে কেন্দ্র করে হয়তো কথাগুলো বলা, কিন্তু সত্যিটা তো মধ্যবিত্ত-লালিত সব নদীকে কেন্দ্র করেই। এমনতর প্রশ্ন নিয়ে যখন নটেগাছের কাছে এসে দাঁড়াই, নটে গাছ খুলে দিতে চায় ইতিহাসের ঝাঁপি। কিন্তু কালানুক্রমের ইতিহাসে আমার দায় কী ? সে তো খুঁজে বেড়াবেন পণ্ডিত গবেষক। ইতিহাসের তথ্যপ্রমাণ হাজির করে তৈরি করবেন সময়কে, সময়ের শৈলীকে। আমি বরং না-মোড়ানো প্রত্ন-প্রাচীন নটের গাছের শিকড়ে শিকড়ে খুঁজি জীবনের গান। যে সরস শিকড়ভূমি বেঁচে থাকে জলের তরঙ্গভঙ্গে, নদীর গতিময় জীবনপ্রবাহের ইঙ্গিতে, ভঙ্গিতে।
হেসে ওঠে জলযৌবন, কিন্তু তার সেই যৌবনতরঙ্গে একটু যে কান্নাও মিশে থাকে গৌরবের সঙ্গে সঙ্গে, তা আড়াল করি কীভাবে?
২
নীলকরের দৌরাত্ম্য মধ্যবঙ্গের আতঙ্কবিশেষ। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকা সম্পাদক হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, ‘অমৃতবাজার’-এর সম্পাদক মহাত্মা শিশিরকুমার ঘোষ, পাদ্রী লঙ সাহেবসহ কয়েকজন কৃষকদরদী ব্যক্তিত্ব এই অত্যাচার থেকে চাষীদের মুক্ত করার বিষয়ে প্রভুত উদ্যোগ নিয়েছিলেন। একটা সময়ে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক ইংরেজি ভাষায় অনুবাদে ভূমিকা গ্রহণ করতে গিয়ে তাঁর জেল হয়। অকালে মৃত্যুবরণ করেন হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়। বাংলাদেশের কৃষকসমাজে তখন প্রবাদের মতো উচ্চারিত হতো,
নীল বাঁদরে সোনার বাংলা করল এবার ছারেখার
অসময়ে হরিশ ম’লো লঙের হলো কারাগার।
এইসব প্রবাদ বা লোকগানের মধ্যে ধরা আছে নীলকর সাহেবদের দৌরাত্ম্যের কথা। আছে নাটকে-উপন্যাসে, কবিতা-গানে। সেসব ইতিহাসের পুনরুচ্চারণ এড়িয়ে বরং আমরা ঢুকে পড়ি আমাদের চেনাজানা বৃত্তের ‘এক যে ছিল দেশ’-এর মাটিতে।
আজকের হাঁসখালি-কৃষ্ণগঞ্জ ব্লক জুড়ে নীলকুঠি ছিল বেশ কয়েকটা। মূলত তিনটে কনসার্ণ এই কুঠিগুলোকে পরিচালনা করত– বাঁশবেড়িয়া কানসার্ণ, খালবোয়ালিয়া কানসার্ণ ও মোল্লহাটি কানসার্ণ। চূর্ণীপাড়ের কালীপাড়া, বয়সাকুঠির হরমন সাহেবের কুঠি এবং গোরাগাঙনির পাড়ে বগুলা নীলকুঠি ছিল খালবোয়ালিয়া কনসার্ণের তত্ত্বাবধানে। এছাড়া বাকি অধিকাংশ কুঠিই ছিল মোল্লাহাটি কানসার্ণের তত্ত্বাবধানে। মোল্লাহাটি কানসার্ণের প্রধান ছিলেন লালমুর। এই অঞ্চলে তখন নীলকরদের সঙ্গে নানান কারণে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন দুজন জমিদার। প্রথম জন হাঁসখালি-গোবিন্দপুরের গোপাল তরফদার, অপর জন শিবনিবাসের জমিদার বৃন্দাবন সরকার চৌধুরী। নীলবিদ্রোহে জমিদার শ্রেণির অবস্থান প্রসঙ্গে এই দুজন অবশ্যই আলোচ্য। এর মধ্যে প্রথম মানুষ গোপাল তরফদার নীলবিদ্রোহের অন্যতম প্রধান শহিদ হিসেবেই গুরুত্ব পাবেন। কিন্তু বৃন্দাবন সরকার চৌধুরী আমাদের আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠেন মূলত ইতিহাস-বিকৃতির কারণে।
নটেগাছ থম মেরে বসে আছে। বাতাসে শ্বাস বাজে হাঁটে হাঁড়ি ভেঙে দেবে না কি?
কী করব বলো ? দায়টা তো আমার নয়, ইতিহাসের। দ্যাখো বাপু, গালগল্প বানিয়ে তোমার দিন চলতে পারে, ইতিহাসের তো চলে না। ফলে আমারে বলতি দ্যাও দিকিনি।
নটেগাছকে চুপ করিয়ে দিয়ে ইতিহাসের কাছে যেতে চাই।
২
বৃন্দাবন সরকার চৌধুরীর নাম যে অঞ্চলের নীলবিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে, তা হলো বগুলার নীলবিদ্রোহ। সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে বৃন্দাবন সরকার চৌধুরীর একটি পরিচয় প্রদান আবশ্যক। বৃন্দাবন সরকার চৌধুরী সম্পর্কে রানাঘাট পালচৌধুরী পরিবারের ভাগিনেয় স্বরূপনগরের জমিদার স্বরূপ সরকার চৌধুরীর পুত্র। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই কৃষ্ণনগর রাজপরিবারের কাছ থেকে শিবনিবাসের জমিদারী কিনে নেন, এবং পুত্র বৃন্দাবন সরকার চৌধুরীকে সেই জমিদারীর দায়িত্ব দিয়ে শিবনিবাস পাঠান। এই তথ্যটি পাওয়া যাচ্ছে ১৯১০-এর ‘Bengal District Gazetters, Nadia-তে। তাঁর এই জমিদারী এলাকার মধ্যে ছিল রাণীনগরে হরমন সাহেবের কুঠিগুলো, যেগুলোর একটির ভগ্নপ্রায় অস্তিত্ব রয়েছে বয়সাকুঠিতে। চূর্ণী নদীর ওপারে চন্দননগরের নীলকুঠি। আবার বৃন্দাবন সরকার চৌধুরীর জমিদারীভুক্ত নয়, এমন নীলকুঠিগুলোর প্রতাপও কম ছিল না। খালবোয়ালিয়া কানসার্ণের অধীনে ছিল ভাজনঘাট ও বগুলার কুঠি। চূড়ান্ত ততদিনে শিবনিবাস জমিদারীভুক্ত এবং তার বাইরে অনেক চাষীর জমি বন্দোবস্ত নিয়ে বিভিন্ন নীলকর সাহেবরা নীলচাষের রমরমা ব্যবসা করে চলেছেন। এঁদের সঙ্গে সরকার চৌধুরীদের মূল বিরোধ শুরু হয় বন্দোবস্তী জমির অধিকার নিয়ে। বিশেষ করে নিশ্চিন্তপুর কানসার্ণের প্রধান লালমুর ও মোল্লারহাটের ফারলঙ সাহেবের তখন প্রবল প্রতাপ। Colesworthy Grant- এর Rural Life in Bengal (১৯৬০) নামের গ্রন্থ থেকে জানা যাচ্ছে ফারলঙ্ ও লালমুরের ‘বেঙ্গল ইণ্ডিগো কোম্পানি’-র জমিদারীভুক্ত ছিল পাঁচশো পঁচানব্বই (৫৯৫) টি গ্রাম। এই বিরাট সম্পত্তির জন্য তাঁরা খাজনা দিতেন তিন লক্ষ চল্লিশ হাজার (৩,৪০,০০০.০০) টাকা। কোম্পানির ঘরবাড়ি এবং অন্যান্য সম্পদের মূল্য ছিল পঞ্চাশ লক্ষ (৫০,০০,০০০.০০) টাকা। কেবলমাত্র নদীয়া জেলাতেই নীলের ব্যবসাতে তাঁরা বিনিয়োগ করেছিলেন আঠারো লক্ষ (১৮,০০,০০০.০০) টাকা।
খুব স্বাভাবিকভাবেই ফারলঙ এবং লালমুরের আগ্রাসন এ চূর্ণী তীরবর্তী জনপদের প্রজাদের উপর এসে পড়ে। এমনকি জমিদার বৃন্দাবন সরকার চৌধুরীর সঙ্গেও এইসব নীলকরদের বিরোধ তীব্র হয়। কেউ কেউ মনে করেছেন, “শিবনিবাস স্বরূপের পুত্র বৃন্দাবন সরকার চৌধুরীর সময়ে আবার জমজমাট হইয়া উঠিয়াছিল। বৃন্দাবন অতিশয় ক্রিয়াবান, চতুর ও প্রাজ্ঞ ছিলেন। তিনি নীলবিদ্রোহে প্রজার পক্ষ গ্রহণ করিয়া বহু ইউরোপীয় নীলকরকে আত্মশক্তিতে দমন রাখিয়াছিলেন। নীলকরেরা তাঁহার নামে কাঁপিয়া উঠিত।” লিখেছেন ‘নদীয়া কাহিনী’ লেখক কুমুদনাথ মল্লিক। এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়াত হারাধন দত্ত লিখেছেন, “পরাক্রমশালী বৃন্দাবন সেদিন এই ঘনঘোর দুর্দ্দিনে প্রজাসাধারণের বিপদমুক্তি কামনায় নিজেকে উৎসর্গ করেন।” ( বৃন্দাবন সরকার চৌধুরী : হারাধন দত্ত। রবিবারের স্বাধীনতা, ১৮ নভেম্বর, ১৯৬১) তিনি বলে গেছেন আরও কিছু কথা। চৌগাছার অতিখ্যাত বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের সঙ্গে তাঁর অন্যান্য বিষয়ে বিরোধ থাকলেও ‘নীলকর বিরোধিতায় অখণ্ড ঐক্য ছিল।’ এবং হারাধনবাবুর সিদ্ধান্ত এই, বৃন্দাবন সরকার চৌধুরী ‘নীলকর উচ্ছেদের ব্যাপারে হৃতসর্বস্ব হইয়া পড়েন– নীলকর সাহেবদের নানাপ্রকার মামলা-মোকদ্দমায় জড়িত হতে বাধ্য হন।’ এবং ‘প্রজাদের বিপদে বৃন্দাবনের এই বাহিনী ( তাঁর একটি লাঠিয়াল বাহিনি ছিল। ) নানা প্রকার সহায়তা করে।’ (পূর্বোক্ত : হারাধন দত্ত )।
নটেগাছ এবার নড়েচড়ে ওঠে। অঞ্জনা-কঙ্কণা-চূর্ণীর জলে কথা বলে ইতিহাস। নীরবতার দেওয়াল ভেঙে চুরচুর। বাতাসে ইতিহাসের পাতা কথা বলে, ফিসফিসিয়ে নয়, বেশ সশব্দে।
১৮৬০ সালে আমাদের ‘এক যে ছিল দেশ’-এর ভূগোল জুড়ে নীলবিদ্রোহের নানা সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায়, ‘অমৃতবাজার’ পত্রিকায়। কিন্তু এমন কোনো বিদ্রোহের খবর পাওয়া যায়নি, যার কেন্দ্রে বা নেতৃত্বে কিংবা পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন বৃন্দাবন সরকার চৌধুরী। বরং ০৬. ০১০. ১২৬৬ অর্থাৎ ইংরেজি ১৮৬০ সালের ‘সংবাদ প্রভাকর’ পত্রিকার ‘সম্পাদকীয় স্তম্ভে’ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বৃন্দাবন সরকার চৌধুরীর ভূমিকা সম্পর্কে ভিন্ন কথা বলে। শুধু তাই নয়, বগুলা-গাড়াপোতা অঞ্চলে নীলবিদ্রোহের এক ভিন্ন ইতিহাস ডানা মেলে। না হে নটেগাছ, তোমার মতো কল্পনার পাখায় ভর দিয়ে নয়, বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে পা রেখেই আমি উড়াল দেব ইতিহাসের কাছে।
নটেগাছ হে, শোনো, তোমার আদালতে সাক্ষ্য দিচ্ছেন গুপ্তকবি, স্বয়ং ঈশ্বর গুপ্ত। ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর সম্পাদকীয় স্তম্ভে তিনি লিখেছেন, “জিলা নদিয়ার অন্তঃপাতি খালবুয়ালিয়ার বিখ্যাত নীলকুঠির অধীন ভাজনঘাট কুঠির অন্তঃপাতি বগুলা নামে অপর এক কুঠি আছে। তাহার নিকটে গোয়াপোতা ( গাড়াপোতা ), শ্যামনগর, বড়চুলুরি ( বড়ো চুপড়ি ) নামে তিনখানা গ্রাম আছে। ইংরাজী ১৮৫৮ সালে নীল বৃক্ষদি উন্নত হইলে এক দিবস কুঠির গোমস্তা আগমন করিয়া অনুমতি প্রচার করেন যে ঐ গ্রামত্রয়ের প্রজারা নীলক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়া উত্তমরূপে তাহার নিড়ান করিবেক।” শুধু এইটুকুতেই থেমে জাননি গোমস্তামশাই। জানান দেন, যতদিন নীলের জমি পরিস্কার না হয়, ততদিন পর্যন্ত চাষীরা নিজেদের ক্ষেতে কোনোপ্রকার কাজ করতে পারবে না। এই ভয়ঙ্কর আদেশ প্রজাদের কাছে বিপদরূপে হাজির হয়। তখন নিজেদের ক্ষেতে কাজের চাপ প্রবল। ঐ আদেশ পালন করতে গেলে সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা। তারা আলোচনা করে গোমস্তাকে বলে, “অন্যান্য বর্ষে আমরা যেরূপ নিয়মে নীলক্ষেত্র নিড়ান করিয়া থাকি, এবারেও সেইরূপ করিতে স্বীকৃত আছি।” সাথে সাথে গোমস্তাকে খুশি করতে চাষীরা ‘তিন গ্রাম হইতে তিনশত টাকা’ গোমস্তামশাইয়ের পূজার নিমিত্ত’ ; সোজা কথায় ঘুষ হিসেবে দিতে রাজি হয়। তবুও শর্ত রয়ে যায়, ‘যত দিবস পর্য্যন্ত সমস্ত টাকা প্রদত্ত না হইবেক তত দিবস পর্য্যন্ত প্রজাদিগকে নিড়ানের কাজে নিযুক্ত থাকিতে হইবে।’
এইসময় শ্যামনগরে ছিলেন না অন্যতম গ্রামপ্রধান কাল্লু মণ্ডল। কয়েকদিন পর বাড়িতে ফিরে আর একজন মোড়ল আমীর মণ্ডলের কাছে সবকিছু জানতে পেরে তাকে সঙ্গে নিয়ে হাজির হন বগুলা নীলকুঠির গোমস্তার কাছে। তাকে সরাসরি জানিয়ে দেন, অন্যদের টাকা সংগ্রহের সময় নেই, কিন্তু আমার টাকা আমি দিয়ে দিচ্ছি। ক্রুদ্ধ গোমস্তা তখন নতুন আদেশ জারি করে বলেন, “তোমার যদি কার্য্যানুরোধ অধিক থাকে, তবে এইক্ষণে স্বয়ং সকল টাকা প্রদান কর। পরে সময়ানুসারে প্রজাদিগের নিকট হইতে টাকা আদায় করিয়া লইবে।” কোনো কথা না বলে কালু চলে আসেন। বলা বাহুল্য, কাল্লু এই আদেশ মানেননি। তখন গোমস্তা তাগিদদার ও সড়কিওয়ালা পাঠিয়ে তাঁকে নির্মমভাবে মারতে মারতে নিয়ে আসে গোরাগাঙনি নদীর পাড়ের বগুলার নীলকুঠিতে। ঠিক এইসময় আর একজন বৃদ্ধ চাষী মজ্জুদ্দিন ( মইজুদ্দিন ) নিজের বাড়ির সামনে বসে কাজ করিছিলেন। সড়কিওয়ালারা অন্যায়ভাবে তাঁকেও বেদম পেটাতে শুরু করে এবং পিঠমোড়া করে বেঁধে নীলকুঠিতে নিয়ে আসে। এইসময় মজ্জুদ্দিন বা মইজুদ্দিনের ভাইপো গাঁয়ের অন্য চাষীদের কাছে খবরটা পৌঁছে দেয়। চাষীরা সমবেতভাবে গ্রামের পথেই তাগিদদার ও সড়কিওয়ালাদের ঘিরে ধরে। শুধু তাই নয়, ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর বয়ান অনুযায়ী “সড়কিওয়ালা এবং তাগিদদারকে প্রহার করিয়া একস্থানে বদ্ধ করিয়া রাখিল, এবং দুইজন প্রজাকে মুক্তিদান করিল।” এভাবেই বাংলাদেশের নীলবিদ্রোহের প্রথম সূত্রপাত হয়, ১৮৫৮ সালে, বগুলার নীলকুঠিতে।
কিন্তু দুর্বল প্রজাদের এই বিদ্রোহ উপযুক্ত সমর্থনের অভাবে বিপর্যস্ত হয়। ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর সম্পাদকীয় স্তম্ভ এই অভিমত প্রকাশেও আশ্চর্যজনকভাবে বস্তুনিষ্ঠ। প্রজারা দরিদ্র, দুর্বল, অসংগঠিত। তাঁদের উপর আক্রমণ-প্রতিরোধে বা প্রতিকারে সহায় কেউ নেই। তাগিদদার ও সড়কিওয়ালাদের তাঁরা ছেড়ে দেন, আর তাগিদদাররা সোজা হাজির হয়ে যায় ভাজনঘাট কুঠিতে। এইসময় ভাজনঘাট ও বগুলার কুঠির তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন মি.মেং টুইড। স্থানীয় মানুষেরা বলতেন মাং টুডু। তিনি ‘পরদিবস প্রাতে ১২ যষ্ঠিধারী হিন্দুস্থানীয় লাঠিয়াল লোক সমভিব্যাহারে গ্রামে উপস্থিত হইলেন। সড়কিওয়ালারা দুইজন প্রজার প্রতি যে অন্যায় আচরণ করিয়াছিল, প্রজারা তদ্বিষয়ে সাহেবকে জ্ঞাপন করিলে তাহা কিছুই শ্রবণ করিলেন না। প্রধান ২ মণ্ডলদিগকে বলিলেন যে তোমরা বগুলার নীলকুঠিতে আইস।”
প্রজারা জানত, কুঠিতে গেলে তাঁদের উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার হবে। সে অভিজ্ঞতা তাঁদের ছিল। কেননা, নীলকরদের অত্যাচার তখন কৃষক প্রজার জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলেছে, এ বিষয়ে চাষী-প্রজারা অজ্ঞাত ছিল না। চূর্ণী নদীর তীরে চন্দননগর নীলকুঠিতে নীলকর সাহেবদের নিজস্ব বিচারের নামে প্রহসনে প্রজার উপর শাস্তিবিধানের খবর গাঁয়ে গাঁয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। ফলে প্রজারা বগুলার নীলকুঠিতে যায়নি। শাসক, সে দেশি বা বিদেশি যাই হোক কৌশল তাদের একরকম। আজকের দিনের শাসকের মতোই সেদিন টুইড সাহেবের ভূমিকা। তিনি জেলার ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে অভিযোগ করলেন, “তাহারা ( চাষী-প্রজারা ) একমত হইয়া গারাপোতা নামক গ্রামে সাহেবদিগের বাটী লুট করিয়াছে, অনেক দ্রব্যাদি ও নগদ টাকা লইয়া গিয়াছে।” অর্থাৎ প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে মিথ্যে মামলা দায়ের। এবং সঙ্গে সঙ্গে শক্তি সঞ্চয় করে প্রতিশোধ গ্রহণের আজকের রাজনীতির পরম্পরার পূর্বসূরি এই নীলকর সাহেবরা। টুইড সাহেব “অভিযোগ উপস্থিত করিয়াই যশোহর হইতে ৫০ জন্ সুশিক্ষিত সড়কিওয়ালা আনয়ন করেন, তাহারা নিকটস্থ গ্রামে গোপনভাবে থাকিয়া অত্যাচার আরম্ভ করে।”
ফলে তাঁরা পেতে চাইলেন জমিদারের সাহায্য। ‘সংবাদ প্রভাকর’ লিখেছে, “গ্রামের প্রজারা পরস্পর একতাবন্ধন করিলে কি করিবে? তাহারা সকলেই নির্ধন, ধনহীনের সপক্ষ কেহই হয় না। তাহারা নীলকরদের সঙ্গে বিবাদ সূত্রে লিপ্ত হইয়া অত্যন্ত ভীত হইল। পরে পরামর্শপূর্বক ধার্য্য করিল যে একজন ধনাঢ্য লোক সাহায্য না করিলে এই বিপদে তাহাদের রক্ষা নাই। অতএব নিকটস্থ জমিদার শ্রীনিবাস নিবাসী বাবু বৃন্দাবন সরকার মহাশয়ের শরণাগত হইবার মানস করিল। কিন্তু সে সময় তিনি বাটী ছিলেন না। তাঁহার ভ্রাতৃপুত্র ছিলেন, তিনি বলিলেন যে কর্তার অনুমতি ব্যতীত কোন বিষয়ে প্রকাশ্যরূপে সাহায্য করিতে পারিব না। কিন্তু নীলকরদের সড়কীওয়ালারা হঠাৎ গ্রামে আসিয়া গৃহাদি লুন্ঠন করিতে না পারে, এমত উপায় করিয়া দিবেন। ইতিমধ্যে বাবু বৃন্দাবন সরকার বাটী আগমন করিলেন, এবং ভ্রাতৃপুত্র প্রমুখ্যাত সর্বশেষ বৃত্তান্ত অবগত হইয়া কহিলেন যে তাঁহার সহিত নীলকরদিগের যে বিবাদ চলিতেছে তাহাতেই তিনি মানরক্ষা ভার বিবেচনা করিতেছেন। জিলার বিচারপতি সাহেবরা সকলেই নীলকরের পক্ষে, অতএব তিনি আর কোন প্রকার নতুন বিবাদে হস্তক্ষেপ করিতে পারিবেন না।”
এই প্রতিবেদন কিন্তু স্পষ্ট করে জানিয়ে দেয় ‘ তাঁহার ( বৃন্দাবন সরকার চৌধুরী ) সহিত নীলকরদিগের বিবাদ’-এ তিনি ‘মানরক্ষা ভার বিবেচনা’ করে ‘নূতন বিবাদে হস্তক্ষেপ’ করতে রাজি হননি। ফলে কুমুদচন্দ্র মল্লিক কথিত ‘তিনি নীল বিদ্রোহে প্রজার পক্ষ গ্রহণ করিয়া বহু ইউরোপীয় নীলকরকে আত্মশক্তিতে দমন রাখিয়াছিলেন’ কিংবা হারাধন দত্তের বক্তব্য ‘প্রজাদের বিপদে বৃন্দাবনের এই বাহিনী নানা প্রকার সহায়তা করে’ কথাগুলো সত্য নয়। সত্য এইটুকুই যে তিনি জমিদারী এলাকার দখল সংক্রান্ত নানা বিষয়ে নীলকরদের সঙ্গে অনেক মামলায় জড়িয়ে পড়েছিলেন এবং সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন।
কী সেই মামলা ? তার সঙ্গে কি প্রজাস্বার্থের কোনো দায় ছিল ? এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে এস লি ইডেন প্রদত্ত জমিদার ও নীলকরদের মধ্যেকার নানাবিধ সংঘর্ষের ব্যাখ্যায়। তদানীন্তন কৃষ্ণনগর জেলায় জমিদার-নীলকর সংঘর্ষের উনপঞ্চাশটি সংঘর্ষের মধ্যে এগারো নম্বরে রয়েছে নীলকর লারমুর ও বৃন্দাবন সরকার চৌধুরীর মধ্যেকার সংঘর্ষ ও মামলার কথা। সেখানে জমিদারী এলাকার বণ্টন ও দখলের কথা উল্লিখিত হলেও নীলবিদ্রোহ বা প্রজাস্বার্থ রক্ষার কোনো কথা নেই।
অবশ্য নীলবিদ্রোহে বৃন্দাবন সরকার চৌধুরীরা অংশ নেননি বলেই তাঁদের ভূমিকা নীলকরদের মতো বা তাঁদের পক্ষে ছিল এমন ভাবার কোনো অবকাশ নেই। যদিও জানি, বৃন্দাবন সরকার চৌধুরীর পিতা স্বরূপ সরকার চৌধুরী ছিলেন রানাঘাট পালচৌধুরী পরিবারের ভাগিনেয়। পালচৌধুরীরা পরবর্তীতে চৌগাছার নীলবিদ্রোহে সর্বস্বান্ত দিগম্বর বিশ্বাসের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। তাতে বৃন্দাবন সরকার চৌধুরীকে মহত্ব দেওয়ার দায় বা দায়িত্ব ইতিহাসের নেই। বরং সেটা একটা ভিন্ন সত্যের সরলীকরণ। বরং দেখতে পারি প্রয়াত কুমুদরঞ্জন মল্লিক কিংবা প্রয়াত হারাধন দত্ত উভয়েই গণবিদ্রোহের ইতিহাস নির্মাণে চালিত হয়েছেন জমিদারতন্ত্রকে মহত্ব দেবার (Glorify) তদানীন্তন সমাজ-মানসিকতা থেকে। হারাধন দত্তের নানান লেখার মধ্যে এই ‘মহত্ব’ দেবার মানসিকতার প্রকাশ ঘটেছে। বলা বাহুল্য, সময়ের পরিপ্রেক্ষিত মাথায় রাখলে এই প্রবণতাকে দোষ দেওয়া যায় না, একথা যেমন সত্য, তেমনই এটাও সত্য যে ইতিহাসের স্বার্থেই মেনে নিতে হবে, নীলবিদ্রোহের ইতিহাসের অংশভাক্ বৃন্দাবন সরকার চৌধুরীরা ছিলেন না।
এই কাহিনির নতুন করে উপস্থাপনা আমরা দেখতে পেলাম ১৯৮৫ সালে। রণজিৎ কুমার সমাদ্দার ‘দৈনিক বসুমতী’র পাতায় লিখলেন কাল্লু মণ্ডল আর আমীর মণ্ডলদের গল্প। কিন্তু কি আশ্চর্য, তিনিও ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর সূত্র উল্লেখ করলেন না। গল্পটা বললেন নিজের মতো করে। উল্লেখযোগ্যভাবে এড়িয়ে গেলেন বৃন্দাবন সরকার চৌধুরীর ভূমিকার কথা। হারাধন দত্ত ও রণজিৎ কুমার সমাদ্দার, দুজনেই সচেতনভাবে এই প্রসঙ্গ বাদ দিয়েছেন, এমন কথা বলার ধৃষ্টতা আমার নেই। কিন্তু এই বাদ দেওয়া-দেওয়ির খেলায় হারিয়ে গেছে নীলবিদ্রোহের প্রথম অভ্যুত্থানের আসল কাহিনি।
ইতিহাসের সচেতন পাঠক বলবেন, ১৮৫৯ সালে সংগঠিতবিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে সংগঠিত নীলবিদ্রোহ কি প্রথম অভ্যুত্থানের দাবি হারাচ্ছে তাহলে ? বিদ্রোহের ব্যাপ্তি ও সক্রিয়তায় চৌগাছার বিদ্রোহ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশর ইতিহাসে গৌরবময় অধ্যায়। কিন্তু এই বিদ্রোহের সক্রিয় ভূমিকা শুরু হয় ১৮৫৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর। বগুলা-শ্যামনগরের বিদ্রোহ শুরু হয় ১৮৫৮ সালের গোড়ায়। তারই ধারাবাহিকতা অনুসরণ করেছে চৌগাছার বিদ্রোহ, যার প্রথম প্রতিরোধটাও গড়ে ওঠে চূর্ণী নদীর তীরে হাঁসখালিতে। সে ইতিহাস নিয়েও আসব নিশ্চয়ই…..
ছবি:সাহেবগঞ্জ নীলকুঠির (প্রতীকী)