দেবু সিংহ,মালদা: আজো আছে, বাঙ্গিটোলার বিখ্যাত মণ্ডা, তবে হয়তো আর বেশি দিন মিলবে না।
শুধু ছানা আর চিনির একটা আনুপাতিক মিশ্রণ।সঙ্গে পরিমাণমতো ক্ষীর আর সামান্য এলাচগুঁড়ো।তার সঙ্গেও যদি কিছু মেশাতে হয়,তা হল ভক্তি,নিষ্ঠা আর সংস্কার।এই উপকরণে তৈরি হয় মালদার ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মিষ্টি বাঙ্গিটোলার মণ্ডা।প্রায় ১০০ বছরের কাছাকাছি সময় পেরিয়েও শেষ হয়ে যায়নি তার ঐতিহ্য।অন্যান্য দেবস্থানের মণ্ডার মতো এই মিষ্টি শক্ত নয় বা এতে চিনির প্রাধান্য নেই।নেই ময়দার মিশ্রণও।স্বাদ অনেকটা কাঁচা সন্দেশের মতো-আর এই স্বাদই তাকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।
মালদার কালিয়াচক-২ নম্বর ব্লকের অন্তর্গত গঙ্গা তীরবর্তী প্রাচীন মৈথিল গ্রাম বাঙ্গিটোলা।সেখানকার ঐতিহ্যবাহী মুক্তকেশী মন্দির সংলগ্ন দোকানগুলিতে এখনো পাওয়া যায় এই মিষ্টি।তবে কতদিন পাওয়া যাবে তা বলতে পারেননা বিক্রেতারা।কেননা নতুন প্রজন্ম মজেছে রকমারি আইটেম মিষ্টিতে।চাহিদা হারিয়েছে মণ্ডা।মণ্ডার কারিগরও অমিল-তাই কাচের শোকেসের এক কোনায় অভিমানে পড়ে থাকে এই ঐতিহ্যশালী প্রাচীন মিষ্টি।এই গ্রামের প্রাচীন বাসিন্দারা বলেন প্রায় ৭০-৮০ বছর আগে এখানকার বাসিন্দা ইন্দুভূষণ ঝা এই মিষ্টি বানানো আরম্ভ করেন।এটি মূলত পূজাকেন্দ্রিক মিষ্টি অর্থাৎ সারাবছর বানানো হলেও পূজা-পার্বনে এই মিষ্টির চাহিদা বেশি।মৈথিল জনজাতি বিষয়ক গবেষকরা বলেন বাঙ্গিটোলার বিখ্যাত মুক্তকেশী মায়ের পূজার ১০০টা ডালার মধ্যে অন্তত ৯০টিতে এখনো অনিবার্য এই মিষ্টির উপস্থিতি।যুগ পরিবর্তনেও ম্লান হয়ে যায়নি এই ঐতিহ্য।
ভক্তি,বিশ্বাস এবং অলৌকিকত্বের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই মিষ্টি অমর হয়ে আছে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে। সাহিত্যিক জয়ন্ত জোয়ারদারের ছোটগল্প ‘খারিজ’এ দেখা যায় অমৃতি মোড়ে একটি পরিবার আকুল আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে- কখন তাদের আত্মীয় মায়ের প্রসাদী বাঙ্গিটোলার মণ্ডা নিয়ে পৌঁছাবে।অভিজিৎ সেন বা অমর মিত্রের ছোটগল্পেও এই মিষ্টির উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে বর্তমানে এই মিষ্টি প্রায় অমিল। এলাকার একটি মাত্র মিষ্টির দোকানে নিয়মিত পাওয়া য়ায় মণ্ডা। বিক্রি কমেছে আগের তুলনায়, বছর সত্তরের ষষ্ঠীচরণ সাহা বর্তমানে একমাত্র কারিগর।তিনি এখনো কাঁপা কাঁপা হাতে তৈরি করে চলেছেন মন্ডা। বর্তমান প্রজন্মের কারিগরদের শেখার প্রতি অনিহা। তাই হয়তো আগামীতে আর মিলবেনা মণ্ডা।
যদি ষষ্ঠীচরণ বাবুর ছেলে উত্তম সাহা পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখার প্রচেষ্টা রয়েছেন। তিনি এখন বাবার কাছে মণ্ডা তৈরি পাঠ নিচ্ছেন। দোকানের অন্যান্য কারিগরদের মণ্ডা তৈরি শেখানোর চেষ্টা করছেন। তবে ষষ্ঠী চরণ বাবুর মত মন্ডা তৈরি এখনো হচ্ছে না তাদের হাত ধরে। অপরদিকে এলাকায় একটিমাত্র দোকানেই পাওয়া যায় তাই এলাকার মানুষের মধ্যে চাহিদাও রয়েছে। তাই বাঙ্গিটোলার এই মণ্ডাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন উত্তমবাবু।